লিটন সরকার বাদল:
কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার বিটেরশ্বর ইউনিয়নের নৈয়ার বাজার থেকে লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসাবে ২০১১ সালে সংগঠনটি বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেন।
২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় প্রায় ৩১ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য কাজ করে সকলের মন জয় করেন। লাল – সবুজ উন্নয়ন সংঘের শুরুটা হয়, দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের উমর ফারুক কবিতার কয়েকটি লাইনের মধ্য দিয়ে ” মায়েরে ঘিরিয়া দুটি শিশু সকরুন সুরে কাঁদিতেছে, আর দুঃখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,উনানে শূন্য হাড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া আকুলে চায়।
এই কবিতা থেকে লাল- সবুজ উন্নয়ন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাওসার আলম স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের জন্য কিছু করার।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে বাবার চাকরির সুবাদে সেনা কল্যাণ সংস্থা থেকে শিক্ষাবৃত্তি পেতেন কাওসার আলম ও তাঁর ছোট বোন ফারজানা আক্তার, অনেক বছরের জমানো টাকা তোলার পর মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা জেগে উঠল কাওসার আলম মনে। শিক্ষার্থীদের সচেতনতামূলক একটি সংগঠন দাঁড় করানোর তাঁর ভাবনার কথা জানালেন ছোট বোন ফারজানাকে, তাঁর বোন সহযোগিতার হাত বাড়ালো বৃত্তির টাকার সাথে ফারজানার এক জোড়া কানের দুল বিক্রি করে সেই টাকায় সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করলেন কাওসার ও ফারজানা।
এই কার্যক্রমে যাত্রা শুরু হলো লাল সবুজ উন্নয়ন সংঘের। কাওসার আলম বলেন,আমি বাবার কাছ থেকে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আর সমাজের জন্য কিছু করার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। প্রতিবছরই নানা কর্মসূচি হাতে নিতেন তিনি।
২০১১ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, চারু কারু প্রতিযোগিতা ও মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন খেলাধূলার আয়োজন করতেন। দিনে দিনে পরিসর বাড়তে থাকল তারপর ২০১২ সাল থেকে যুক্ত হলো সবুজ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে লাল সবুজের প্রচেষ্টা, সবুজ করবো দেশটা শ্লোগানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।
প্রথমত স্কুল, কলেজে গাছের চারা রোপণ করতেন তারপরে সংগঠন কিছুটা বড় হলে ভিন্নরকম উদ্যোগ নেন, গ্রামের প্রতিটি ঘরে গাছের চারা পাঠাতে স্কুলকে বেছে নেন লাল সবুজ উন্নয়ন সংঘ তারা উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে গিয়ে সেখানের স্কুল অথবা কলেজে প্রতি শিক্ষার্থীদের হাতে একটি করে গাছের চারা দেন।
শিক্ষার্থীরা সেই চারা নিয়ে মাদক ও ধর্ষণমুক্ত বাংলা গড়ার শপথ নেন। ২০১৩ সালে সংগঠনের মাধ্যমে মাদক, বাল্যবিবাহ ও ধর্ষণবিরোধী সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে কাওসার আলম ঘুরলেন বেশ কয়েকটি জেলা। তারপর স্কুলে স্কুলে ঘুরে শিক্ষার্থীর নানান সমস্যার কথা শুনতেন কাওসার। তাদের কথাগুলো দায়িত্বশীল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই কর্মসূচির পরিকল্পনা করছিলেন। সে ভাবনা থেকেই বাংলাদেশ ভ্রমণে সচেতনতার কর্মসূচি। ২০১৮ সালে ৮ মার্চ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া থেকে শুরু হয় এই কর্মসূচি। কাওসার আলম বলেন, তেঁতুলিয়ায় প্রথম দিন প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী মাদক, যৌন হয়রানি, বাল্যবিবাহ, যৌতুক ও দুর্নীতিকে “না” বলে লাল কার্ড প্রদর্শন করে এটা দেশজুড়ে সাড়া ফেলে মনে মনোবল জাগ্রত হয়। এরপর আরও উৎসাহ নিয়ে কাজে নেমে পড়েন।
এক দিনের এই অনুষ্ঠান তিনটি ধাপে করা হয়। প্রথমে মতবিনিময় সভার মতো করে শিক্ষার্থীদের সমস্যার কথা শোনেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাৎক্ষণিক সমাধানও বাতলে দেওয়া হয় অনেক জায়গায়। এরপর মাদকের বিরুদ্ধে শপথ করানো হয় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের, এরপরের পর্বে থাকে লাল-সবুজ কার্ড প্রদর্শন।উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক, স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় লাল-সবুজ উন্নয়ন সংঘের কমিটি হয়েছে। সারা দেশে এই সংঘের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় তিন হাজার।
যাদের সবাই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াএই শিক্ষার্থীরা প্রতি মাসে টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে ১০ টাকা করে সংঘের তহবিলে জমা দেন। সেই টাকায় স্কুল-কলেজে চলে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে বাল্যবিবাহ, মাদক ও দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা পাশাপাশি চলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা উপকরণ বিতরণ ও বৃক্ষরোপণ। গত কয়েকবছরে ৫ লাখ গাছের চারা দেন শিক্ষার্থীদের।
গত মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার পরেও তাঁদের কার্যক্রম থেমে নেই। সংগঠনের প্রতিটি কমিটির সদস্যরা নিজেদের দেওয়া চাঁদার অর্থ দিয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী, মাস্ক ও সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণ করেছেন। এ ছাড়া মানুষকে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সচেতন করতে কাজ করছেন সংগঠনটির সদস্যরা।
কাওসার বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো ভালো মানুষ গড়ে তোলা। আমরা প্রতিজন সদস্য যদি অন্তত ৫ জন করে মানুষকে মাদক ও বাল্যবিবাহ থেকে দূরে রাখতে পারি তাহলে বছরে ১৫ হাজার মানুষকে ভালো রাখতে পারবো আর এভাবে তারা নিজকে পরিবর্তন করে অন্যকে ভালো রাখবে। আর এতেই সত্যিকার সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। আমাদের এই কাজও সার্থক হবে।