বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি স্বাধীনতা

0
150

প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান হেলাল:
এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল- বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা।পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সামরিক শক্তির শাসন, শোষণ ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে একটি আদর্শিক চেতনায় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনের রূপকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লাগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিছিন্নতাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারির সম্মেলন বর্জন করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬ দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬ দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সংগে মিল রেখে।

৬ দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য-পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র, ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে এই ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। ৬ দফা কর্মসূচির ভিত্তি ছিল ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। পরবর্তীকালে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ যে একে ‘ম্যাগনা কার্টা’ বা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদও বলা হয়।

৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় ছাড়া সব ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি পৃথক ও সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে। সরকারের কর, শুল্ক ধার্য ও আদায় করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকাসহ দুই অঞ্চলের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার আলাদা হিসাব থাকবে এবং পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষা ঝুঁকি কমানোর জন্য এখানে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন ও নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন।

বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ৬ দফা ব্যাপক সমর্থন পায়। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ১৯৬৬ সালে ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের এক সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী। তাকে এ ধরনের হয়রানিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
৭ জুন আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতার মুক্তির দাবিতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন তথা বাঙালি জাতির মুক্তির ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ণ দিবস হরতাল আহবান করেছিল। অভূতপূর্বভাবে সে হরতাল সাড়া দেয় ছাত্র-শ্রমিক-জনতাসহ সারা দেশের মানুষ। হরতাল বানচাল করতে পুলিশ ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, ওয়াজিউল্লাহসহ ১১ জন এবং নারায়ণগঞ্জে সফিক ও শামসুল হক নিহত হন। আহত হন অনেকেই।

সরকারের বিরূপ প্রচারণা ও অত্যাচারে ৬ দফা আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ৬ দফা যখন জনগণের ব্যাপক সমর্থন পায় ঠিক সেই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে অভিযুক্ত করে এক নম্বর আসামি করা হয়। স্বৈরাচারী শাসকেরা ভেবেছিল মামলা দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন নিঃশেষ করে দেবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত। আগরতলা মামলা দায়েরের পর তিনি পরিণত হন মহানায়কে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার চূড়ান্ত পরিণতি। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সুপরিকল্পিত ও ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি অনুসরণ করেই একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর জাতি তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য খুঁজে পায়।

আজ তারই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ একটি আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পিতার রাজনৈতিক দর্শনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শেখ হাসিনার আত্মনিবেদন ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বাংলাদেশকে অচিরেই পৌঁছে দেবে কাঙ্ক্ষিত স্থির লক্ষ্যে। যে লক্ষ্য বাস্তবায়নের স্বপ্ন নিয়ে এদেশের অগণিত রাজনৈতিক কর্মী মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সুদীর্ঘ সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে আত্মাহুতি দিয়েছেন।

লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরিষাবাড়ী উপজেলা শাখা জামালপুর ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।