২২ অর্থ-বছরের জন্য ২,০৭,৫৫০ কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুমোদন এনইসি’র

6
290

জাতীয় অথর্নৈতিক পরিষদ (এনইসি) আজ চলতি ২০২২ অর্থ-বছরের জন্য ২ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি অনুমোদন করেছে। এতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া অব্যাহত রয়েছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এম মান্নান বৈঠকের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, ‘এনইসি চলতি অর্থ-বছরের জন্য ২ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা আরএডিপি অনুমোদন দিয়েছে।’

এনইসি চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট সচিবগণ রাজধানীর শের-এ-বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কক্ষ ও বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষ থেকে বৈঠকে যোগ দেন।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশন সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সচিবগণ ব্রিফিংকালে উপস্থিত ছিলেন।

পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদ্বীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, এডিপি’র মূল বরাদ্দ ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪.১৪ কোটি টাকা থেকে ১৭ হাজার ৭৭৪.১৪ কোটি টাকা (এডিপি’র মূল বরাদ্দের ৭.৮৯ শতাংশ) হ্রাস করা হয়েছে। বিদেশী অর্থায়ন থেকেই এই ১৭ হাজার ৭৭৪.২৩ কোটি টাকা কর্তন করা হয়েছে। এর ফলে এখন বিদেশী সূত্র থেকে প্রাপ্ত এই অর্থায়ন দাঁড়াল ৭০ হাজার ২৫০ কোটিতে। আর স্থানীয় সূত্র থেকে এই অর্থায়ন কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও কর্পোরেশনগুলোর বরাদ্দ ৯ হাজার ৬১৩.৬৮ কোটি টাকা বিবেচনায় আনলে, চলতি অর্থ-বছরে সার্বিক আরএডিপি বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ১৭ হাজার ১৬৩.৬৮ কোটি টাকা। গত অর্থ-বছরে (২০২১) আরএডিপি’র পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।

পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, আজকের আরএডিপি বৈঠকে দেশের অর্থনীতির ছয়টি ক্ষেত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে- যেগুলো গত অর্থ-বছরে প্রায় ৭ শতাংশ জিডিপি অর্জন করেছিল। কৃষি খাতের খুব ভাল অবদানের কারণেই সরবরাহ চেইন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গত বছর মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর এ কারণেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের, এমনকি বেশ কিছু উন্নত দেশের তুলনায়ও আমাদের দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে খুব সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

এনইসি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর কিছু নির্দেশনা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেন্ডার কারসাজি রোধে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)-এর অধীনে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ) দ্বারা পরিচালিত ই-জিপির কার্যক্রম পরিচালনার প্রশংসা করেছেন।

এনইসি চেয়ারপার্সন চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত বছরের তুলনায় মহামারি সত্বেও প্রায় দুই শতাংশ বেশি হওয়ায় সার্বিকভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ধন্যবাদ জানান।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা প্রকল্প প্রণয়ন এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া আরও সহজতর করা ও জমি অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিগ্রস্থদের বকেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা দ্রুত বিতরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের সময় কেউ যাতে অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করতে না পারে এজন্য প্রস্তাবিত ভূমির ছবি নিয়ে রাখতে নির্দেশ দেন।

পরাশক্তি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে মান্নান বলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধবিরোধী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও বারবার শান্তির পক্ষে কথা বলেছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের চলমান কাজে সরাসরি প্রভাব পড়বে না, যেহেতু রাশিয়া প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, জ্ঞান ও অর্থায়ন একটি একক চ্যানেলের মাধ্যমে সরবরাহ করছে । তিনি আরও বলেন, “আমার পর্যবেক্ষণে, আমি কোন প্রভাব দেখতে পাচ্ছি না, তবে আমি আগামীকাল সম্পর্কে কথা বলতে পারি না। এখন পর্যন্ত, আমি কোন প্রভাব দেখতে পাচ্ছি না…যুদ্ধের উত্তাপ অবশ্যই আছে, কিন্তু আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতি তা অনুভব করছে না…।”

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জেনারেল পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি হার প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এখনো কম। তিনি বলেন, ‘আমরা বাজারে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের ক্রয় ক্ষমতা আগের তুলনায় এখন ভালো, যার জন্য মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব এখন কম।’

বৈঠকে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব প্রদীপ বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন একনেক সভায় প্রদত্ত তাঁর নির্দেশাবলীর দ্বিতীয় সংকলনের মোড়ক উন্মোচন করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আরএডিপি’তে বৈদেশিক বরাদ্দ কমেছে। আরএডিপি’তে সবোর্চ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত দশটি সেক্টর হচ্ছে সড়ক এবং যোগাযোগ সেক্টর ৫৫,৮২৭.৩৬ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী সেক্টর ৩৯,২১৪.০৯ কোটি টাকা, গৃহায়ন ও কমিউনিটি ফ্যাসিলিটি সেক্টর ২৩, ৫৯৫.৫১ কোটি টাকা, শিক্ষা সেক্টর ২০,৮২৪.৪৬ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন সেক্টর ১৫,৫২০.২৯ কোটি টাকা, স্বাস্থ্য খাত ১৩, ৭৯৭.২৬ কোটি টাকা,পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সম্পদ সেক্টর ৯,০৮৪.৯৮ কোটি টাকা, কৃষি খাত ৭,২৭৯.৪৮ কোটি টাকা, শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাত ৪,৫৩৭.৮৪ কোটি টাকা এবং জনশৃঙ্খল ও নিরাপত্তা সেক্টর পেয়েছে ৩,৪৭৮.০৫ কোটি টাকা।

নতুন আরএডিপি’তে সবোর্চ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত মন্ত্রনালয় এবং বিভাগ হচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ ৩৪,৩৫০.২৮ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগ ২৮,২৯২.২৮ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ বিভাগ ২২,.৯১ কোটি টাকা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি মন্ত্রনালয় ১৫, ৮৯৪.১৫ কোটি টাকা, রেল মন্ত্রনালয় ১২,৫৭৫.৯০ কোটি টাকা,স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ৯,৯৮৫.৪২ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় ৯,২০৭.৩৪ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৮,২৫৯.৭৩ কোটি টাকা, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় ৭,৩৮৭.৩৬ কোটি টাকা, সেতু বিভাগ ৫,৭২৩.কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রূপপুর পারমানবিক প্লান্ট প্রকল্প পেয়েছে ১৪,৮৩৬.৩৯ কোটি টাকা, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ৬,১৬২ কোটি টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী (পিইডিপি-৪) ৬,১৩৮.০৩ কোটি টাকা, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প ( প্রথম সংশোধিত) ৬,১৩৭.৩৪ কোটি টাকা, ঢাকা ম্যাচ ট্রানজিট ডেপোলপমেন্ট প্রকল্প (এমআরটি-৬) ৪,২৩৩ কোটি টাকা, হযরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর সম্প্রসারন ( প্রথম ধাপ ও প্রথম সংশোধিত) ৩,৪৭২.৬০ কোটি টাকা,পদ্মা বহুমুখি সেতু নির্মান প্রকল্প (দ্বিতীয় সংশোধিত) ২,৪৯৯.৯৯ কোটি টাকা,এসএএসইসি সড়ক সংযোগ প্রকল্প-টু : ইলেঙ্গা – হাতিকুমরুল- রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নয়ন প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত) ২,৩৪৪.৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মান প্রকল্প ২,১৭৭.৩৫ কোটি টাকা এবং ভূমি অধিগ্রহন ও ইউটিলিটি ট্রান্সফার প্রকল্প: ঢাকা (কাঞ্চনপুর)-সিলেট-তমাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরন এবং উভয় পাশে পৃথক সাভির্স লেন নিমার্ন প্রকল্প ২,১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ পয়েছে।

প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য চলতি অর্থ বছরে আরএডিপি’তে প্রায় ১,৭৭০ টি প্রকল্প অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে ১,৫২০টি প্রকল্প হচ্ছে বিনিয়োগ প্রকল্প, বাকি ১৪২টি প্রকল্প হচ্ছে কারিগরি সহায়তা প্রকল্প। ১০৮ টি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৭৮ টি প্রকল্প চলতি অর্থ বছরের আরএডিপিতে পাবলিক প্রাইভেট পাটনারশিপ (পিপিপি) এর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য রাখা হয়েছে।