স্মৃতির পাতায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম

0
386

শেখর দীপু

কারনে অকারনে তাঁর কাছে কতবার যে গিয়েছি হিসেব নেই। কখনো অফিসে, কখনো অফিসের লাইব্রেরীতে, কখনো বাসার লাইব্রেরীতে। এ মামলার নথি তো সে মামলার আর্গুমেন্ট, রেফারেন্স- রীতিমতো পড়াশোনার রাজ্যে ডুবে আছেন। এমন বেরসিক অনেক সময়ে আমি যেয়ে হাজির। স্যারের নিত্যসহচর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত দা হয়তো বলে উঠলো স্যার দীপু আসছে। আমি কোনোদিন তাঁকে হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি। 
বাংলাদেশের ইতিহাসে এতো এতো হাই-প্রোফাইল মামলা কখনোই একযোগে আদালতে মুভ হয়নি যেটা হয়েছিলো মাহবুবে আলমের সময়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে যুদ্ধাপরাধের মামলাগুলো আপিল বিভাগে আসতো চুড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য। গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান। দশট্রাক অস্ত্র মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা। কনস্টিটিউশনাল ডিসপিউট ফিফথ, সেভেন্থ, থার্টিন্থ, সিক্সটিন্থ অ্যামেন্ডমেন্ট। এ জামিন সে জামিন, পিআইএল নানাবিধ একটারপর একটা। রাশি রাশি নথি, স্টাডি, সাবমিশন, রাজনীতি। আমি একদিন বললাম, স্যার এতো লোড কীভাবে নেয়া সম্ভব? উনি হাসলেন। মৃদু হাসি।

তাঁর সমালোচকরা অনেকেই ক্ষোভ উগরে দিতেন, গোচরে কিম্বা অগোচরে। দলকানা, হেনত্যান অনেককিছু। এগুলো যারা বলতেন তারা ননসেন্স। অ্যাটর্নি জেনারেল পোস্টটা পলিটিক্যাল। সরকার তার পছন্দমতো লোককে ওই পদে বসাবে এটাই স্বাভাবিক। দুনিয়ার বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাসিতে এটাই রীতি। সেভাবেই হয়ে আসছে। সমালোচোকরা কথায় কথায় আমেরিকা ইংল্যান্ড উন্নত দেশের উদাহরন আনতে পঁটু। কিন্তু ওইসব দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলরা কতটা বুক চওড়া করে সরকারের স্বার্থসিদ্ধির কাজগুলো করে যান সেবিষয়ে নিন্দুকেরা নিশ্চুপ। অনেকটা চাচীর রান্না করা ডালের জায়গায় জায়গায় ঝালের মতো!!

বাংলাদেশের ইতিহাসে মাহবুবে আলম সম্ভবতো দীর্ঘতম সময় অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ছিলেন। এমন একটা নেভিগেশন পজিশনে এত লম্বা সময় থেকেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দূর্নীতির অভিযোগ আসেনি। যেখানে আওয়ামীলীগের মন্ত্রী-এমপি, নেতা চামচার অনেকেই দূর্নীতির ভারী পানিতে ( ডিউটেরিয়াম অক্সাইড) ডুব সাঁতার খেলেছেন, খেলছেন।

মনেপ্রানে একজন প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্যের তিনিই ধারক বাহক ছিলেন বলে মনে করি। একদিন কথায় কথায় বললেন, শেখর তুমি কি খেয়াল করেছো বাংলাদেশের নবজাতক শিশু কিশোরদের নামের ধারা কীভাবে বদলে যাচ্ছে? কত সুন্দর সব বাংলা নাম, তা রেখে বাপ-মা রা ছুটছে পাকিস্তানী সৌদী স্টাইলে! রসিকতা করে বললাম, তা স্যার আপনার সন্তানদের কি নাম? হাসতে হাসতে বললেন ছেলের নাম- সুমন, মেয়ের নাম- শিশির কনা। এত সুন্দর নাম শুনে আমি চুপ মেরে গেলাম।

আদালতের সাবমিশন সাধারনত কাটখোট্টা টাইপ। কিন্তু উনার সাবমিশনে মাঝে মাঝে রবীন্দ্রনাথ আসতো, বঙ্গবন্ধু আসতো, বিশ্ব রাজনীতি আসতো, দর্শন, ইতিহাস, যাপিত জীবনের টানাপোড়েন আসতো। অবশ্যই তা প্রাসঙ্গিকভাবে। স্যার বলতেন মানুষের জীবনের থেকে বড় কিছু নেই। দেশ, আইন আদালত, সংবিধান, সরকার সবকিছুই মানুষের জন্য। শুধু আইনের রশি দিয়ে মানুষের জীবনকে বেঁধে ফেলা সঠিক না। বিচারকার্যে এগুলোও বিবেচ্য।

অ্যাটর্নি জেনারেলের মৃত্যুর খবরে কিছু কিছু শয়তান ফুরফুরে মেজাজে অভিব্যাক্তি দিয়েছে দেখলাম। আসলে বাংলাদেশে একজন মাহবুবে আলমের কাছে অনেক বড় একটা প্রতিক্রীয়াশীল গোষ্ঠী সপাটে চড় খেয়েছে। এটা তাদের ক্ষোভের বহি:প্রকাশ। তাঁর চপেটাঘাতে মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের লালচে কপোল আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আসলে সব রঁসুনের গোড়া একই। একজন মানুষের পক্ষে সবার মন জোগানো সম্ভব নয়। যারা তাঁর প্রতিপক্ষ তাদের তো নয়ই। কি যায় আসে তাতে! গাঙ্ দিয়ে সারি গেয়ে যাক না!!

সাধারনত কারো সাথে আমার তেমন সেল্ফি তোলা হয়না। নিজে বিখ্যাত, আলোচিত বা সমালোচিত কিছুই নই। নিভৃতচারী, আটপৌরে আমি। তবে সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, রাষ্ট্রের অনেক ক্ষমতাবান-পপুলারদের সাথে মেশা বা যোগাযোগ ছিলো, আছে। কাচুমাচু হয়ে ”অমুক ভাই তমুক নেতার সাথে” নিজের মুখখানা জুড়ে দেয়া টাইপ ছ্যাবলামি আমি পারিনা। বিগত বছরগুলোতে সম্ভবত আমি দু’ বা তিনজনের সাথে সেল্ফি তুলেছি। মহাশ্বতা দেবী, মাহবুবে আলম। আরো একজন আছে! যাই হোক। একদিন জেপুটি অ্যটর্নি জেনারেল দিলীরুজ্জামান ভাই (বর্তমানে বিচারপতি) ফোন করে বললেন, অ্যাটর্নী স্যার পিঠা খাওয়ার নিমন্ত্রন দিয়েছেন। অনেকেই আসবে, আপনাকেও স্যার আসতে বলেছেন। আমার এই ছবিটি সেই পিঠা খাওয়ার টেবিলে তোলা। স্যারকে আমি বললাম স্যার একটা স্মৃতি রাখি। আবারো হাসলেন।

স্যারের মৃত্যুর খবরটা নিতে পারিনি সহজে। খবরটা পাবার পর ফোন করেছিলাম ডিএজি বিশ্বজিত দা কে। স্যার তোমার কথা মাঝে মাঝে বলতেন। দীপু’র কি খবর। এত প্রানবন্ত একটা মানুষ। নিউইয়র্কে আমি যে এরিয়াতে থাকি বা যে এরিয়াতে করোনার ভয়াবহ দিনগুলোতে আমি দিনের পর দিন ডিউটি করেছি সেই কুইন্সে একক জোন হিসেবে পৃথিবীর হাইয়েস্ট ডেথ রেট ছিলো। প্রতিদিন ৩০০/৪০০ করে মানুষ এখানেই করোনাতে মারা গেছে। সব মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিছু কিছু নয়। অত মানুষের মৃত্যু আমাকে বিচলিত করলেও এফোঁড় ওফোঁড় কষ্ট দেয়নি। একজন প্রগতিশীল, স্বপ্নবান আধুনিক মানুষ অ্যাটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমের অকাল প্রস্থান অনেক বেদনাদায়ক !!


লেখকের প্রোফাইল
শেখর দীপু এক দশকেরও বেশী সময় বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিম টেলিভিশন সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি দেশের জনপ্রিয় ও প্রথম সারির টেলিভিশন এটিএন বাংলা’র বার্তা বিভাগে সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও আলোচিত “যুদ্ধাপরাধের বিচার” ও সাজা কার্যকরের পুরো প্রক্রিয়া নিউজ রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি আলোচিত, সমালোচিত, জনপ্রিয় বিভিন্ন বিষয়ের সচিত্র প্রতিবেদনের মাধ্যমে দেশে তিনি পরিচিত একজন মুখ। পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনার ও ফেলোশীপে অংশগ্রহনের জন্য তিনি নেপাল, শ্রীলংকা, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালী, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিন আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেন। টেলিভিশনের অস্কার খ্যাত “এমি অ্যাওয়ার্ড” (EMMY AWARD) জয়ী এটিএন বাংলার ডকুমেন্টারী ফিল্মের স্ক্রীপ্ট রাইটার ও উপস্থাপক ছিলেন শেখর দীপু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পিস্ এন্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ’বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কে কম্পিউটার সাইন্সে পড়াশোনার পাশাপাশি শেখর দীপু বর্তমানে নিউইয়র্ক সিটি’র পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আছেন।