সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী দ্বারা দ্বিখণ্ডিত কাজিপুরে নতুন উপজেলা জরুরি

0
410


শহিদুল ইসলাম নিরব

জেনে খুব খুশি হয়েছি যে দেশে আরো তিনটি নতুন উপজেলা অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। উপজেলাগুলো হলো মাদারীপুরের ডাসার, কক্সবাজারে ইদগাও ও সুনামগঞ্জের মধ্যনগর।

কিন্তু একই সাথে অত্যন্ত দুঃখিতও হয়েছি যে প্রমত্তা যমুনা দ্বারা দ্বিখণ্ডিত কাজিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত যমুনাচরের অবহেলিত জনপদের জন্যে প্রত্যাশিত’শহিদ এম মনসুর আলী অথবা মোহাম্মদ নাসিম নগর ‘ উপজেলাটি অনুমোদন পায় নি। যে উপজেলাটি অনুমদিত হওয়া ছিল সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেটিই হলো না।

প্রমত্তা যমুনা দ্বারা চিরতরে বিচ্ছিন্ন কাজিপুরের পিছে পড়া ও অবহেলিত চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্যে এবং বিমাতাসুলভ বৈষম্য মূলোৎপাটনের জন্যে নতুন উপজেলা করা আশু আবশ্যক। কাজিপুর উপজেলা ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। যার মোট আয়তন প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিলোমিটার। যার ৬টি ইউনিয়ন যমুনার পূর্বপাড়ে, ৬টি পশ্চিমপাড়ে। পূর্বাংশের ৬টির আয়তন ২০৩ বর্গ কিলোমিটার এবং নদীসহ পশ্চিমাংশের আয়তন ১৬৫ বর্গকিলোমিটার। পূর্বপাড়ের অংশ জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার মূল ভূ-খণ্ডের সাথে সংযুক্ত। যা পশ্চিমপাড় থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমপাড়ের অংশ সিরাজগঞ্জের সাথে সংযুক্ত। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে সর্বনাশী যমুনা। কাজিপুর উপজেলার সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম যমুনার পশ্চিমপাড়ে হওয়ায় পূর্বপড়ের মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রশাসনিক কাজের জন্যে নিয়মিত পশ্চিম পাড়ে যেতে হয়। যেখানে যেতে মানুষের জীবন থাকে হাতের মুঠোয়। সময়ও লাগে প্রায় ঢাকা যাওয়ার সমান। অতীতে ঝড়বৃষ্টিতে শতশত লোক নৌকা ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। যাদের কোর্ট কাচারিতে মামলা মোকাদ্দমায় হাজিরা থাকে তাদের আগের দিন সকালেই নৌকাযোগে পাড় হয়ে যেতে হয়। তা না গেলে পরের দিন গেলে কোর্ট ধরার কোন উপায় থাকে না। এ সব চরের মানুষ যদি মারামারি করে সকালে খুন হয়, প্রশাসন আসতে আসতে রাত হয়ে যায়। অথচ এ সকল এলাকার মানুষের সরিষাবাড়ি যেতে সময় লাগে মাত্র কয়েক মিনিট । তবুও এ চরাঞ্চলের মানুষকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুগ যুগ ধরে পশ্চিমপাড়েই যেতে হয়। রাজনীতির কাছে মানুষের জীবন যেন ছেলের হাতের মুয়া। এই সব চরের মানুষ নৌকা পাগল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভক্ত, শেখ হাসিনার ভক্ত, মোহাম্মদ নাসিমের ভক্ত, শহিদ এম মনসুর আলীর ভক্ত, এমনকি তানভীর শাকিল জয়ের ভক্ত । এ সব চরের মানুষ শতকরা ৯৯.৯ পার্সেন্ট ভোট দেয় নৌকা প্রতিককে । স্বাধীনতার পরে কাজিপুরে কখনো নৌকা প্রতিকে হার মানে নি। কিন্তু ভোটের বিনিময়ে এই চরের মানুষের উপর চল বৈষম্য। চলে রাজনৈতিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য, উন্নয়নের বৈষম্য, শিক্ষায় বৈষম্য এবং সকল ধরণের বৈষম্যে শিকার হয় এই নদীভাঙা মানুষ

বৈষম্য বুঝানোর জন্যে আমি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। নিম্নের পরিসংখ্যান দেখলেই পরিস্কার হয়ে যাবে যে চরাঞ্চলের মানুষ কতোটা বৈষম্যে শিকার।

কাজিপুরে সাধারণ কলেজের সংখ্যা মাত্র ১৪ টি। তবে পূর্বপাড়ের ছয়টি ইউনিয়নের জন্যে মাত্র দুটি। আর বাকি ১২টি পশ্চিমপাড়ের মানুষের জন্যে। কাজিপুরে কারিগরি কলেজের সংখ্যা ১৪টি, তার সবগুলোই যমুনার পশ্চিমপাড়ে। পূর্বপাড়ে কোন কারিগরি কলেজ নেই। কাজিপুরে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬ টি । যার ৪২ টি যমুনার পশ্চিমপাড়ে। পূর্বপাড়ে ১৪টি । কাজিপুর উপজেলায় মোট দশটি ব্যাংক এর শাখা অনুমোদন পেয়েছে, সেই দশটি ব্যংকের মধ্যে যমুনার পশ্চিম পাড়ে ৯টি । এবং পূর্বপাড়ে একটি । এ উপজেলায় মোট ৪টি হাসপাতাল রয়েছে তার সবগুলোই পশ্চিমপাড়ে । কাজিপুরে মোট ৮টি ভেটেনারি আছে যার ৭টি যমুনার পশ্চিমপাড়ে, মাত্র একটি দেওয়া হয়েছে পূর্বপাড়ে। খাদ্যশস্য মজুত রাখার জন্যে ৪ টি গুডাউন, তার সবগুলোই যমুনার পশ্চিমপাড়ে। কাজিপুরে ২টি জমি রেজিস্ট্রি অফিস আছে যার একটিও পূর্বপাড়ে নেই, দুটিই পশ্চিমপাড়ে। কাজিপুরে একটি মাত্র পৌরসভা সেটাও যমুনার পশ্চিমপাড়ে।

এছাড়া সরকারি হাই স্কুল ও কলেজ পশ্চিম পাড়ে, হাপাতাল, থানা সবকিছুই যমুনার পশ্চিমপাড়ে।

কাজিপুরের পশ্চিমপাড় রক্ষা করার নামে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বাঁধ নির্মাণের জন্যে বরাদ্দ করা হয়। আর যমুনার পূর্বপাড় রক্ষার জন্যে কোনদিন কোন বরাদ্দ হয়েছে বলে জানা নেই। যমুনার পূর্বপাড়ে কৃষি আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ডাবোল থাকলেও গোডাউন বরাদ্দ পশ্চিম পাড়ে, যমুনার পূর্বপাড়ে গবাদিপশু পালন বেশি হলেও ভেটেরিনারি সব পশ্চিমপাড়ে।

কাজিপুর উপজেলার নামে বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ ব্যায় করা হয় যমুনার পশ্চিমপাড়ের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে।

কাজিপুরের যে ম্যাপটি আছে তা অনেক আগের। বর্তমানে যদি ম্যাপ করা হয় তবে যমুনার পশ্চিমপাড়ের চেয়ে পূর্বপাড়ের স্থলভাগের আয়তন প্রায় তিন গুণ বেশি হবে। উভয়পাড়ে মানুষের অনুপাতও প্রায় সমান সমান। যমুনার পশ্চিমপাড় রক্ষার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায়ের বাঁধ নির্মাণ করা হলেও পশ্চিমপাড় রক্ষা করা যায় নি। পশ্চিমপাড় ভেঙে ছোট হয়ে গেছে। কিন্তু ম্যাপ পুরোনো হওয়ায় সঠিক তথ্যটি জানা যায় না।

যমুনার পূর্বপাড়ের চরের মানুষ রাজনৈতিকভাবেও চরম বৈষম্যে শিকার হয়। কারণ যতগুলো রাজনৈতিকদল আছে তার অধিকাংশই নেতৃত্ব দেয় যমুনার পশ্চিমপাড়ের মানুষ।

এখন প্রশ্ন হলো এই যমুনার পূর্বপাড়ের মানুষ জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে কেন যমুনা পাড়ি দিয়ে কাজিপুর বা সিরাজগঞ্জ যাবে? কেন এই চরের মানুষ তাঁদের জীবনের নিরাপ্তা পাবে না? কেন তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে? কেন তাদের শিক্ষা অধিকারে বৈষম্যে শিকার হতে হবে? কেন তাদের চাকরিতে বৈষম্য শিকার হতে হবে?

কেন সরকার শুধু যমুনার পশ্চিমপাড় রক্ষাবাঁধ নির্মান করেন, পূর্বপাড় রক্ষাবাঁধ কেন নির্মাণ করা হয় না ? পূর্বপাড়ের মানুষ কি ভূমি উন্নয়ন কর দেয় না?

অপরদিকে যমুনার পূর্বপাড়ের মানুষ যদি নদীপথে জীবন হাতের মুঠোয় না নিয়ে, যদি স্থলপথে কাজিপুর যেতে চায় তবে তাকে প্রথমে আসতে হবে জামালপুরের সরিষাবাড়ি, তারপরে টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর এরপরে যমুনা সেতু পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলায় যেতে হবে, তারপরে সেখান থেকে যেতে হবে কাজিপুর। ততক্ষণে একজন লোক প্রায় ঢাকা পৌঁছে যাবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি জনস্বার্থে দুটি বা তিনটি ইউনিয়ন নিয়ে নতুন উপজেলা দিয়েছেন। তবে এই চরাঞ্চলের অবহেলিত চিরবঞ্চিত মানুষেরা কেন ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে একটি উপজেলা পাবে না?

বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহকর্মী জাতীয় নেতা শহিদ এম মনসুর আলীর নামানুসারে প্রস্তাবিত ‘মনসুর নগর’ উপজেলা দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করে অবহেলিত, চিরবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া নদীভাঙা চরের মানুষ।