বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর মাহমুদ দারভিশ

255
1107


মী ম মি জা ন

মাতৃভূমি। কী আবেগজড়িত একটি নাম ও স্থান! পৃথিবীর স্বর্গ। আর এরকম স্বর্গ ও আবেগজড়িত স্থানথেকে মাত্র সাতবছর বয়সে যিনি বিতাড়িত হয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারভিশ। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, জাতীয় কবি, অবিসংবাদিত নেতা, রাজনীতিবিদ ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের লেখক মাহমুদ দারবিশ ১৯৪১ সালের ১৩ মার্চ পশ্চিম প্যালেস্টাইনের আল বিরবা গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন সেলিম, একজন ভূমিমালিক। তার মাতা হাওরিয়াহ দারবিশ ছিলেন অশিক্ষিত। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। তিনি তার দাদার কাছে পড়তে শেখেন। তার ৮৫ বছরের বৃদ্ধা মাতা এখনো জীবিত আছেন।

১৯৬০ সালে হাইস্কুল থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার পর মাহমুদ দারবিশ হাইফা চলে যান। সেখানে তিনি ‘রাকা’র মুখপত্র আল ইত্তেহাদের এডিটর হন। এখানে তিনি অনুবাদেরও কাজ করতেন। সেসময় তিনি সাপ্তাহিক আল জাদিদেরও দ্বায়িত্ব পালন করতেন। সেখান থেকে তিনি ১৯৭০ সালে মস্কো যান পলিটিক্যাল ইকোনোমিতে পড়াশুনা করতে। তার পর থেকে তার জীবনে শুরু হয় একের পর এক অভিবাসন। ১৯৭১ সালে তিনি কায়রো যান দৈনিক আল আহরামে কাজ করতে। এটাই ছিল তার জীবনে প্রথম কোনো আরব দেশে যাওয়া; সেটাই ছিল প্রথম যার সব কিছু আরবি।

১৯৮৮ সালে তিনি প্যালেস্টাইনের সরকারি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লেখেন। তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পাদিত ‘অসলো’ চুক্তির প্রতিবাদে তিনি সেখান থেকে পদত্যাগ করেন।

ষাটের দশক থেকে কাব্যচর্চায় নিয়মিত এই কবি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন ফিলিস্তিনি জনগণের কণ্ঠস্বর। তার কবিতা ধারণ করেছে রাষ্ট্রবিহীন ভূখণ্ডের অজস্র মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর বেদনাকে। মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতায় ঘুরপাক খাওয়া ফিলিস্তিনিদের দুঃখ দুর্দশার চিত্র আঁকতে গিয়ে কবিতায় তিনি নিয়ে এসেছেন সমগ্র বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের ছবি। কবিতার মাধ্যমে মানবতার মুক্তির জন্য তার আর্জি দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন। তাই তাকে ‘সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর’ হিশেবে অভিধা দিয়েছেন সমালোচকগণ।

এ পর্যন্ত তার প্রায় ৩০টি কাব্য এবং আটটির মতো গদ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মূলত কবিতা লিখলেও অসাধারণ সুন্দর গদ্যও রচনা করেছেন। আরবিতেই লিখতেন তিনি। তবে ইংরেজি, ফরাসি এবং হিব্রু ভাষাতেও ভালো দখল ছিল তার। প্রায় ২৫টি ভাষায় তার রচনা অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে প্রায় কুড়িটির মতো গ্রন্থ। ফ্রান্সে বরাবরই বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকত তার গ্রন্থ।

তার কাব্যের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে, আসাফির বিলা আজনিহা (উইংলেস বার্ডস; ১৯৬০), আওরাক আল-জায়তুন (লিভস অব ওলিভস; ১৯৬৪), আসিক মিন ফিলাস্তিন (এ লাভার ফ্রোম প্যালেস্টাইন; ১৯৬৬), আখির আল-লাইল (দি এন্ড অব দি নাইট; ১৯৬৭), আহাদ আসের কাওকাবান (ইলেভেন প্লানেটস; ১৯৯২), জিদারিয়াহ (মুরাল; ২০০০) হালাত হিসসার (স্টেট অব সিজ; ২০০২) প্রমুখ।

তিনি অসংখ্য পুরুস্কারে ভূষিত হন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দি লোটাস প্রাইজ (১৯৬৯; ইউনিয়ন অফ আফ্রো-এশিয়ান রাইটারস), লেনিন পিস প্রাইজ (১৯৮৩; ইউএসএসআর), দি নাইট অব দ্যা অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস (১৯৯৩; ফ্রান্স), দি লেননান ফাউন্ডেশন প্রাইজ ফর কালচারাল ফ্রিডম (২০০১), প্রিন্স ক্লস এওয়ার্ড (২০০৪), বসনিয়ান স্টিকেক (২০০৭), গোল্ডেন রিদ অব স্ট্রাগা পোয়েট্রি ইভিনিংস (২০০৭), ইবনে সিনা পুরস্কার।

সারাবিশ্বের নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর, খ্যাতনামা কবি, বিপ্লবের প্রতীক মাহমদু দারবিশ ২০০৮ সালের ১০ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হসটনে মোমোরিয়াল হারমেন হসপিটাল ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রামাল্লাহর প্যালেস অব কালচারের সন্নিকটে এক পাহাড়ি পরিবেশে ‘প্রিন্স অব প্যালেস্টাইন’খ্যাত মাহমুদ দারভিশ’কে দাফন করা হয়।

মাহমুদ দারভিশ’র অনেক কবিতার ভাষান্তরের সাথে বাংলাভাষী পাঠক পরিচিত হয়েছেন। তার মাতৃভূমি ও প্রেমনিয়ে চমৎকার দু’টি কবিতার ভাষান্তর করেছি। উক্ত কবিতা দু’টি এবং উপর্যুক্ত তথ্যাবলী ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এবং ‘পোয়েম হান্টার’ থেকে সংগৃহীত।


১.

আমাদের মাতৃভূমির প্রতি
মূলঃ মাহমুদ দারভিশ

ইংরেজিঃ ফাদি জৌদাহ
আমাদের মাতৃভূমির প্রতি,
আর এটি প্রভূর কথার নিকটের একটি,
মেঘপুঞ্জের ছাদ

আমাদের মাতৃভূমির প্রতি,
এটা বিশেষণথেকে বিশেষ্যের অন্ত এমন একটি
অনুপস্থিতির মানচিত্র
আমাদের মাতৃভূমির প্রতি,
আর এটি সুক্ষ্ন তিল বীজের মতই সুক্ষ্ন একটি, একটি নৈস্বর্গিক দিগন্ত…আর একটি লুকায়িত ফাটল

আমাদের মাতৃভূমির প্রতি,
আর এটি এমনই নিঃস্ব যেন বুনো হাঁসের ডানা,
পবিত্র বই…আর একটি আহত পরিচিতি

আমাদের মাতৃভূমির প্রতি,
আর এটি এমনই একটি যা বিদীর্ণ পাহাড়দ্বারা বেষ্টিত আমাদের মাতৃভূমির প্রতি, আর এটি একটি যুদ্ধের পুরস্কার
আকাঙ্ক্ষা ও দহনের থেকে মৃত্যুর স্বাধীনতা
আর আমাদের মাতৃভূমি, এটার রক্তময় রাতে,
একটি জহরত যেটি সেই দূরবর্তীগুলোর থেকেও উজ্জ্বল
আর এটি প্রজ্জ্বল করে যা তার বাহিরে আছে…
যেমনটি আমাদের জন্য, অভ্যন্তরে,
আমরা আরো হাঁশফাঁশ করছি!

[আমাদের মাতৃভূমির প্রতি, মাহমুদ দারভিশ’র ‘The Butterflies’ Burden’ গ্রন্থের ‘To Our Land’ কবিতার রূপান্তর]

২.

অধিকও নই, কমও নই!
মূলঃ মাহমুদ দারভিশ

ইংরেজিঃ ফাদি জৌদাহ

আমি একজন ললনা। অধিকও নই, কমও নই!
আমি আমার জীবনকে তার মতই বাঁচাই
সুতার পরে সুতা
আর আমি পরার জন্য আমার উলকে ঘুরাই,
না হোমারের গল্পকে শেষ করার জন্য নয়,
না তার দীপ্তিকেও নয়।

আর আমি দেখি, যেটিকে তার মতো দেখি তার গরনে
যদিও আমি প্রত্যেকবার স্থীরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি
তার ছায়ার দিকে
পরাজয়ের স্পন্দন অনুভব করার জন্য,

আর আমি আগামীকাল লিখব
গতকালকের পাতাসমূহঃ সেখানে কোনো শব্দ নেই প্রতিধ্বনি ছাড়া।
আমি পছন্দ করি নিশাচরের বাক্যের প্রয়োজনীয় অস্পষ্টতা
পাখির অনুপস্থিতিতে
বাক্যের ঢলের উপরে
ও গ্রামগলির ছাদের উপরে

আমি একজন ললনা। অধিকও নই, কমও নই!
কাজুবাদামের কলি আমার সীমানায় উড্ডয়ন পাঠিয়েছে

আমার অলিন্দ হতে,
সেই দূরবর্তী পথ যা তার আকাঙ্ক্ষায় বলছেঃ
“আমায় স্পর্শ করো! আর আমি আমার অশ্বগুলো সলিল বসন্তে নিয়ে আসব।”

আমি রোদন করি কোনো স্পষ্ট কারণের জন্য নয়,
আর আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমার মতই,
ভাররক্ষকের মতো নয়
না বৃথায় নয়

আর আমার স্কন্দ হতে একটি সকাল উদিত হবে তোমার জন্য
আর তোমাতে পতিত হবে, যখন আমি তোমাকে আলিঙ্গন করবো এক রাতে।
কিন্তু আমি কেউ নই, কেউই নয়,
আমি ভানুও নই শশীও নই

আমি একজন ললনা। অধিকও নই, কমও নই!
তাই কামনার চুম্বন হও, যদি চাও।
আর আমার জন্য, আমি সেরকম ভালোবাসতে পছন্দ করি
যেমনটি, আমি কোনো রঙ্গীন ছবি নই একটি কাগজে,
অথবা এমন একটি ধারনা
যার দ্বারা স্তুপের মধ্যে একটি কাব্য রচনা করা হয়েছে…

শয়নকক্ষ হতে আমি শুনেছি দূরের লায়লার চিৎকারঃ
একটি উপজাতীয় রাতের ছড়ার জেলাধ্যক্ষের কাছে আমাকে ছেড়ে যেও না
আমাকে তাদের কাছে খবরের ন্যায় রেখে যেও না…

আমি একজন ললনা। অধিকও নই, কমও নই!
আমি সেই যে আমি,
যেমনটি তুমি যেরকম তুমিঃ
তুমি আমাতে বাসকরো আর আমি তোমাতে বাসকরি, তোমাতে আর তোমার জন্য

আমি ভালোবাসি আমাদের পারস্পরিক ধাঁধাঁর নির্মলতার প্রয়োজনীয়তা
আমি তোমারই যখন আমি নিশিকে উম্মত্ত করি
কিন্তু আমি কোনো ভূমি নই
অথবা কোনো বিহার

আমি একজন ললনা। অধিকও নই, কমও নই!
আর আমি টায়রা পরি
শশীর স্ত্রীসুলভ ঘূর্ণায়ন থেকে
আর আমার গিটার অসুস্থ্য হয়ে পড়ে

তার
থেকে তারে
আমি একজন ললনা,
অধিকও নই
কমও নই!

[‘অধিকও নই, কমও নই!’ মাহমুদ দারভিশ’র ‘The Butterfly’s Burden’ গ্রন্থের ‘No more, No less’ কবিতার রূপান্তর]