বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যা বেড়েছে

5
582

মতিউর তানিফ: 

করোনাকালে দীর্ঘ প্রায় সাত মাস ধরে বন্ধ রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় নানা কারণে হতাশাও বাড়ছে অনেকের। আবার অনেকে নানা ধরনের সহিংসতা বা বিরুপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছেন। এ অবস্থায় আত্মহত্যার মতো কঠিন পথও বেছে নিচ্ছেন অনেকে। এমনকি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে মহাপাপ জেনেও অনেকে এ পথ বেছে নিচ্ছেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে অন্তত ১৭ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। অভিমান কিংবা নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে যেকোন মানসিক জটিলতায় এ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা। চাকরি থেকে হতাশা কিংবা প্রেম সংক্রান্ত কারণেও এ পথ বেছে নিচ্ছেন তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন এরমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত তিন শিক্ষার্থী রয়েছেন। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীও।

নর্থ সাউথ ছাত্রী ফাতিহা নুরের আত্মহত্যা
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত ৮ জুন ছারপোকা মারার ওষুধ খেয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্র রাসেল হোসাইন। এরপর গত ২৯ আগস্ট আত্মহত্যা করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) জারমিন আক্তার জুঁই। আর গত ৩ অক্টোবর ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বকুল দাশ।

গত ২৮ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টক্লাস সেকেন্ড ছাত্র ফিরোজ কবির। এছাড়া মাস্টার্সে ৭ম হওয়ায় আত্মহত্যা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগের প্রথম শ্রেণিতে প্রথম তাইফুর রহমান প্রতীক। বউ-শাশুড়ির অপমানে গত ৭ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) নববিবাহিত ছাত্র রবিউল আলম।

গত ২৯ রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টবয় সবুজ মিত্র আত্মহত্যা করেন। এদিকে জন্মদিনে উইশ না করায় গত ২২ এপ্রিল আত্মহত্যা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী প্রিয়াংকা সাহা। অপরদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হংস প্রসাদ হিমু গত ১০ জানুয়ারি ফেইসবুকে লাশের ছবি পোস্ট করে আত্মহত্যা করেন। গত ৪ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাকিব ভুঁইয়া।

চিরকুট লিখে ঢাবি ছাত্রের আত্মহত্যা
ফেইসবুকে স্ট্যাটাসের পর গত ৮ জুন আত্মহত্যা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সঞ্জু দেব। প্রেমের কারণে বাবা-মা বকা দেয়ায় গত ১ জুলাই আত্মহত্যা করেছেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন রায়হান উদ্দিন সজিব। আর ঝগড়া শেষে গত ২০ আগস্ট আত্মহত্যা করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তাসকিয়া নুহাশ। গত ৪ জুন নিজ বাসা থেকে শুভ্র জ্যোতি টিকাদার নামে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়।

এদিকে অনার্স পরীক্ষায় তিন বিষয়ে ফেল করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রী মনিজা আক্তার মিতু আত্মহত্যা করেন ১৬ জুলাই। এছাড়া গত ২১ এপ্রিল রাতে বয়ফ্রেন্ডকে ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ইডেন কলেজের ছাত্রী সায়মা কালাম মেঘা।

রোগের যন্ত্রণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ছাত্র প্রথম শ্রেণি পাওয়া আবদুল্লাহ আল নোমান গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। গত ২ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ৪৯তম ব্যাচের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেন। তার নাম ফাতেমা এলিন ফুজি। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার জাদুঘর মোড় এলাকায় তার বান্ধবীর মেসে ওই ছাত্রী গলায় দড়ি পেচিয়ে আত্মহত্যা করেন।

এদিকে গত ১৩ নভেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছেন। ওইদিন অচেতন অবস্থায় ওই ছাত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর গত ১২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তার নাম অনিন্দ ইশরাক। তিনি আইবিএ ২২ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।

আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ
এসব আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেকেই রেজাল্টে সন্তুষ্ট হতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। কেউবা পারিবারিক সহিংসতা বা কলহের শিকার হয়ে এ পথ বেছে নিয়েছেন। এছাড়া প্রেমঘটিত ব্যাপারে আত্মহত্যা করেছেন অনেকে। চাকরি না পেয়ে কিংবা বয়স শেষ হওয়ায়ও অনেকে এ পথ বেছে নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলছেন, করোনার কারণে আত্মহত্যা, সংঘাত, পারিবারিক কলহ, চুরি, ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ বেড়েছে। মানুষ আবদ্ধ হয়ে থাকলে, কাজ না থাকলে, বিরক্ত হয়ে গেলে, আয় না থাকলে, এক সাথে থাকতে গেলে এরকম ক্রাইসিসের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়। এর মধ্য দিয়ে যেতে গেলে আমাদের ভেতরের নেতিবাচক অনুভূতিগুলো বের হয়ে আসে। হোমিসাইড বা সুইসাইড যাই বলি না কেন এটাই হচ্ছে রেজাল্ট।

আত্মহত্যার মূল কারণগুলো কি?

অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম এর মতে, প্রথমত বাইরের প্রভাবে আমরা এমনটাই করি। আর অপরটি হলো আমাদের ব্যক্তিত্বে গঠনটা কি রকম? ছোটবেলা থেকে আমরা যথেষ্ট আদর-ভালোবাসা পেয়ে বড় হয়েছি কিনা বা আমাদের বাবা মায়ের সাথে আমাদের বোঝাপড়াটা ভালো ছিলো কিনা? আমাকে পরিবার বুঝতো কিনা সেটা বড় বিষয়। বাবা-মায়ের সাথে যাদের সম্পর্ক দৃঢ় থাকে তারা মানসিকভাবে অতোটা অস্থির হয়ে যায় না। ওদের আগে থেকেই বন্ধনটা ভালো থাকে। বিপদে পড়লে পরিবারের কাউকে না কাউকে তারা অবগত করে। এমন কেউ থাকা দরকার যে তার মনের কথাটা শোনে। তাকে বুঝতে পারে।

তবে কেবল পরিবারগুলোকেই দোষ দিতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলছেন, অনেকক্ষেত্রে পরিবার তাদের সম্পর্কে জানে না। পরিবারকে কেউ শেখায় নি। তাদেরকে দোষারোপ করা যাবে না। এমনি এমনি একটা বাচ্চার মন বোঝা সহজ নয়। আমাদের মানসিক গঠনেই মূল সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।