বইমেলায় প্রথমদিন থেকেই পাওয়া যাচ্ছে রাশেদ রেহমান এর ‘নদীর নাম যমুনা’

0
297

শহিদুল ইসলাম নিরবঃ
সুজলা সুফলা নদী বাংলা। নদীর প্রবহমনতার মতই আমাদের জীবন প্রবহমান বললেও বেশি বলা হবে না। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ যাতায়াত, মাছধরা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে নদীপথ ব্যবহার করে আসছে। প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম এই নদীগুলো তাই মানুষের যাপিত জীবনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। সাহিত্যে জন-জীবনের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় বলেই বাংলা সাহিত্য প্রেমীদের মন-মননে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলো যতটা রেখাপাত করতে পেরেছে অন্যগুলো তা পারেনি। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’, ‘গঙ্গা’ কিংবা ‘জলপুত্র’ প্রভৃতি উপন্যাস যেমন বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে তেমনি এর রচয়িতারাও সাহিত্যপ্রেমীদের হৃদমাঝারে যশস্বী হয়ে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল ধরে। তরুণ কথাশিল্পী রাশেদ রেহমানের ‘নদীর নাম যমুনা’ও তেমনি একটি নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস। যমুনা পাড়ের খেটে খাওয়া মানুষদের নদীকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকার আখ্যান লেখক নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন কাব্যিক ধারাভাষ্যে।
নদীর কূল ভাঙা, কূল গড়া দেখে অভ্যস্ত নদী তীরবর্তী মানুষ স্বভাবতই সাহসী হয়ে থাকে। উত্তাল নদীর বিভিন্ন রূপ দেখে বেড়ে ওঠা জীবন তাদের। যমুনা পাড়ের নাটুয়াপাড়ার মল্লিকবাড়ির তানিম তাদেরই একজন। নদীর নাম যমুনা উপন্যাসে তানিমকে মুখ্য চরিত্র বলা গেলেও মূলত লেখক উপন্যাসের কাহিনী এগিয়ে নিয়েছেন যমুনার কালো জলকে আবর্ত করে, যেখানে আছে অনেক বিয়োগান্তক বর্ণনা। যমুনা তার উপকূলবর্তী মানুষজনের জীবন প্রবাহে যে প্রভাব রেখে চলেছে তাই উঠে এসেছে নদীর নাম যমুনা উপন্যাসে।
লেখক কাহিনী শুরু করেন একটি নৌ-দুর্ঘনাকে কেন্দ্র করে। চাকুরির ভাইবা দিয়ে পাবনা থেকে ফেরার পথে একটি বাঁশ বোঝাই নৌকায় আরোহন করে তানিম। দুর্ভাগ্যক্রমে তাদের নৌকাটি একসময় ডুবে যায়। অন্য অনেকের সঙ্গে তানিমেরও শুরু হয় জীবন নিয়ে ভেসে থাকার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা। কাঁচা বাঁশের দঙ্গল আকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তানিম। সাহায্যকারী নৌকার আশায় চেয়ে চেয়ে একসময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। যমুনার জলে মাছ শিকার তানিমদের প্রধান পেশা। আবার এই যমুনাই বারবার তাদের পরিবারে অভিশাপ হয়ে এসেছে। তানিমের মানসপটে ভেসে ওঠে ওর ছোট বোন আনোরার কথা। শৈশবে স্কুল থেকে ফেরার পথে বাঁধভাঙা জলে হারিয়ে যায় ছোট্ট আনোরা। অনেক খুঁজেও তাকে আর পাওয়া যায়নি।
যমুনার সর্বনাশা ভাঙনের কবলে পড়ে তানিমদের আজ নিঃস্ব অবস্থা হলেও একসময় তাদের বেশ জায়গাজমি ছিল। তানিমের দাদা গফুর মল্লিক ছিলেন সরকারি ভূমি অফিসের তহসিলদার। একবার জমিজমার কাজ নিয়ে গফুর মল্লিক বড়ভাই গোলজার ব্যাপারীর সাথে গঞ্জে যায়। ফেরার পথে গফুর মাস্তুলের ডগায় উঠে পাল ঠিক করতে গিয়ে ছিটকে পড়ে পানিতে। তারপর জ্বরে ভুগে দশদিনের মাথায় সকলের মায়া ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমায় পাঁচ ভাইয়ের ছোটভাই গফুর মল্লিক। তানিমের দাদা যখন মারা যায়, তানিমের বাবা আবুল মাঝির বয়স তখন সবে দশ বছর। কিছুদিন পর মা রাহেলা বেগমও স্বামীর পথ অনুসরণ করলে ছোট্ট ভাইবোনদের নিয়ে অকূল দরিয়ায় পড়ে যায় আবুল মাঝি। সংসারের সংজ্ঞা জানার আগেই সে হয়ে যায় সংসারের কর্তা ব্যক্তি।
সময় থেমে থাকে না। আবুল বড় হয়। পরিণত বয়সে আয়েশা নামের এক মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় আবুল মাঝি। বছরান্তে কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান, যার নাম রাখা হয় আলিম। মাঝির ছেলে মাঝিই হবে, এইতো প্রকৃতির ধরাবাধা নিয়ম। এই পর্যায়ে লেখক এক মর্মান্তিক কাহিনীর অবতারণা করেছেন। সে রাতে বোয়াল মাছ ধরতে যাওয়ার সময় নয় বছরের আলিম বায়না ধরে বাবার সাথে যাওয়ার জন্য। মায়ের সম্মতি আদায় করে ছোট্ট আলিম বাবার সাথে নৌকায় চড়ে। ছেলেকে নৌকার অপর প্রান্তে বসিয়ে জুইতা হাতে দক্ষ শিকারি আবুল মাঝি বোয়াল মাছ তালাশ করছিলেন। হঠাৎ একটা বোয়াল লেজ ঝাপটালে ঝপাত করে জুইতা নিক্ষেপ করে লাফ দিয়ে পানিতে নামে আবুল। আচানক অপর প্রান্তে পাটের শোলায় কিছুর নড়াচড়া দেখে বড় বোয়াল ভেবে সে অপর জুইতা হাতে নিয়ে নিশানা করে আমূল গেথে দেয়। আদতে তা বোয়াল মাছ ছিল না, তার নৌকা থেকে লাফিয়ে নামার সময় তাল সামলাতে না পেরে তন্দ্রাচ্ছন্ন আলিম ঝুপ করে পানিতে পড়ে গিয়ে অথৈ জলে দাপাদাপি করছিল। আবুল মাঝির যখন হুশ ফেরে ততক্ষণে সব শেষ। নিজের দোষে আদরের শিশুপুত্রের ইহলীলা সাঙ্গ হয়ে গেল। বারবার মূর্ছা যেতে থাকে সে।
সাহিত্য রচনা অনুভব-অনুধাবনের বিষয় হলেও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবেই তাতে ভিন্নমাত্রা যোগ করে। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস নিজেও একজন কৈবর্ত পরিবারের সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই তাই অন্যদের তুলনায় তার নদীকেন্দ্রিক বা জেলেজীবন সংক্রান্ত রচনা অধিকতর প্রাণবন্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের লেখক রাশেদ রেহমানও বেড়ে উঠেছেন যমুনা বিধৌত নাটুয়াপাড়ার বিভিন্ন চরে দাপিয়ে বেড়িয়ে। নদীর সাথে তারও রয়েছে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। তার ‘নদীর নাম যমুনা’ উপন্যাসটি দীর্ঘকাল যাবৎ সাহিত্যপ্রেমীদের মনে জায়গা করে নিতে সমর্থ হবে এই আমাদের প্রত্যাশা।