টেকসই উন্নয়নের বড় বাধা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব

6
334

দিডেইলিনিউসান ডেস্কঃ

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি’র সাগর-রুনি মিলনায়তনে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশ (এনসিসি’বি) এর উদ্যোগে বৃহস্পতিবার (১৭ জুন ২০২১) ‘জীবন ও জীবিকার অগ্রাধিকার : ন্যায্যতা ও সুশাসন’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রস্তাবিত জলবায়ু বাজেট ২০২১-২২ বিষয়ে নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা ও ভাবনা তুলে ধরতে ‘জীবন ও জীবিকার অগ্রাধিকারঃ ন্যায্যতা ও সুশাসন’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং সভাপত্বি করেন নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশ (এনসিসি’বি) এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক (রিসার্চ এন্ড এ্যাডভোকেসি) ড. মুহাম্মদ ফররুখ রহমান। অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিষ্ট ফোরামের সভাপতি জনাব কাউসার রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক এবং সুন্দরবন ও উপকুল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক জনাব নিখিল চন্দ্র ভদ্র, এবং জনাব মোজাম্মেল হক, সিনিয়র অফিসার – জলবায়ু পরিবর্তন, সেইভ দ্যা চিলড্রেন, ঢাকা অফিস ।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, বাংলাদেশ (এনসিসি’বি) এর রিসার্চ এন্ড এ্যাডভোকেসি এ্যাসোসিয়েট মিসেস প্রতীতি কামাল।

লিখিত বক্তব্যে ড. মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেন, বাংলাদেশের অভীষ্ট টেকসই উন্নয়নের বড় বাধা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব। মনুষ্যসৃষ্ট এই অভিঘাত আজ বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সরকার সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তা উত্তরণে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন।

এ বছর ২৫টি মন্ত্রণালয়/বিভাগের মোট বরাদ্দ ৫৭.৩৩ শতাংশ (৩৪৬,১০৬.৪০ কোটি টাকা)। এবং মোট জলবায়ু সম্পৃক্ত বরাদ্দ হল ৭.২৬ শতাংশ (২৫,১২৪.৯৮ কোটি টাকা)। গত অর্থবছরসহ পূর্বের তিনটি অর্থবছরেও ধারাবাহিকভাবে জলবায়ু সম্পৃক্ত বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ মন্ত্রণালয়ের মোট বাজেটের ৩১.০২ শতাংশ বরাদ্দ জলবায়ু সংশ্লিষ্ট – যা গত অর্থবছর অপেক্ষা ১২.১৯ কোটি টাকা কম।

বিসিসিএসএপি’তে বরাদ্দকৃত বর্তমান অর্থবছরসহ বিগত সময়ে ‘সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা’, ও ‘গবেষণা ও নলেজ ম্যানেজমেন্ট’ এ বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। ‘দক্ষতা বৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জোরদারকরণ’ খাতে বর্তমান অর্থবছরে ২০২০-২১ সংশোধিত বাজেটের তুলনায় কম বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যা সামগ্রিক বিচারে কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
পাশাপাশি তিনি এবারের বাজেটে জলবায়ু সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা এবং তহবিলসমূহে ব্যয়ের ছয়টি প্রধান ধারার বিষয়ে বিশ্লেষন প্রদান করেন। এই অর্থবছরে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড এ শুধুমাত্র কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প বৃদ্ধি ছাড়া গত ২০২০-২১ অর্থবছরের সাথে প্রকল্প সংখ্যা এবং বরাদ্দে কোন পার্থক্য নাই। নিজস্ব তহবিলে পরিচালিত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রকৃত চাহিদা মাফিক প্রকল্প গ্রহণ ও মূল্যায়নে যথার্থ ভূমিকা পালনের দুর্বলতা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয়েছে।

তিনি জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলা এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক বিষয়। পাশাপাশি কোভিডের মত অপ্রত্যাশিত মহামারির প্রার্দুভাবে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলা করা আরো জটিলতর হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সক্রিয় জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সমাজের সূদৃঢ় অবস্থান থাকা স্বত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি জলবায়ু কার্যক্রমে তাদের কার্যকরি অংশগ্রহণের বিষয়গুলি এখনো অমীমাংশিত অবস্থায় রয়েছে।

জনাব মোজাম্মেল হক বলেন বাংলাদেশ ক্লাইমেট ইনডেক্ট এ দুর্যোগগ্রস্ত দেশের তালিকায় সবসময়ই থাকে। ঘোষিত বাজেটে বিপন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষত শিশু, নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রকল্প বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেন। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় শিশু, নারী, তরুন জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তা বৃদ্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ সিভিএফ’র সভাপতি হিসেবে উচিত অনুসরণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা। জিসিএফ ফান্ড এর প্রক্রিয়া কিভাবে সহজতর করা যাবে তা সরকার এবং এনজিও প্রতিনিধিদের সহযোগিতা বাড়ানোর প্রয়োজন।

জনাব নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্ত রোধে অনেক প্রকল্প হাতে নিয়েছেন।

কিন্তু যখন আমরা বর্তমান বাজেটের দিকে তাকাই তখন কিছু হাতাশার চিহ্ন উপলব্ধি হয়। তিনি বলেন যত প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে উপকূলীয় অঞ্চল তত ক্ষতিগ্রস্থ হয়, বর্তমানে সংসদ সদস্যরাও এই ব্যাপরে অবগত । তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন ‘আমাদের ত্রাণ নয় বাধঁ দরকার’। যদি অবহেলিত উপকূলীয় সকল অঞ্চল নিয়ে সরকার দ্রুত কাজ না করে, তাহলে সরকারের এই শত শত উন্নয়ন সাগরে পানিতে ডুবে যাবে। উপকূলের মানুষদের বাচাতে এটার বিকল্প কিছু নাই।

তিনি আরো বলেন , জীবন ও জীবিকাকে আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে, এর কোন বিকল্প নাই। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন করলে শুধু হবে না, দ্রুত আমাদের উপকূলের উন্নয়ন করতে হবে তা না হলে জাতিয় উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশের অর্থ সামাজিক ক্ষতির সাথে জনজীবন বিপর্যস্ত হবে।

জনাব কাউসার রহমান তার বক্তব্যে বলেন পরিবেশ দিবসের সময় বর্তমান বাজেট উপস্থাপিত হলেও পরিবেশ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি, তা খুবই হতাশাজনক। বর্তমানে পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের বাজেতের অর্থ বিগত বছর গুলো থেকে তুলনামূলক কমে গেছে। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের বাজেট খরচ করার যে কর্মদক্ষতা তাও তুলনামূলক অনেক কমে গেছে । গত অর্থবছরে মূল বাজেটের অর্থ তারা খরচ করতে সক্ষমতা দেখাতে পারেনি । পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের উচিৎ কর্মদক্ষতা বাড়াতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। করোনা থেকে কিছুসময় পরে আমরা হয়তো মুক্তি পাব, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন থেকে মুক্তি খুবই আশু নয়।

পেশকৃত সুপারিশ/দাবি
১) প্রতিবছর জিডিপি’র কমপক্ষে এক শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বরাদ্দ করতে হবে। জলবায়ু বাজেটের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন খাতে প্রতিবছর কমপক্ষে ১০ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে।

২) জলবায়ু অর্থায়নকে একটি তহবিল থেকে পরিচালনার লক্ষে এবং জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে অবিলম্বে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন, ২০১০ পরিবর্ধন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বেসরকারি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভূক্ত করে একটি জলবায়ু কমিশন গঠনে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

৩) বাজেট প্রতিবেদনে বিগত অর্থবছরের প্রকল্প ব্যয়ের পরিমান শুধুমাত্র সংখ্যায় প্রকাশ করাই সার নয়। প্রতিবেদনে প্রকল্প ব্যয়ের প্রকৃত যথার্থতা মূল্যায়ন প্রকাশের মাধ্যমে অযাচিত প্রকল্প অনুমোদন না করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

৪) জলবায়ু অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহে প্রয়োজনে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার, দূষণকারী যানবাহন, বিমান ভ্রমন ও বিমানে মালামাল পরিবহণের উপর ‘সবুজ কর’ আরোপ করতে হবে। এবং এই অর্থ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

৫) অর্থমন্ত্রণালয়ের প্রবর্তিত ‘বাংলাদেশে ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওর্য়াক’ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিটি বিভাগের জন্য পৃথক ‘স্থানীয় (জেলাভিত্তিক) ক্লাইমেট ফিসক্যাল ফ্রেমওর্য়াক’ তৈরী করতে হবে। জাতীয় জলবায়ু কমিশনের আওতায় জলবায়ু অর্থায়নকে বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে সমণি¦ত করা যেতে পারে।

৬) গৃহীত বেশিরভাগ জলবায়ু প্রকল্পগুলো ‘জনগনের জন্য’ প্রণীত হলেও অনেকক্ষেত্রেই তা ‘প্রকৃত জনগন সম্পৃক্ত’ হয়ে উঠে না। তাই জলবায়ু প্রকল্পগুলোতে ‘স্থানীয় প্রভাবসমূহকে’ বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এবং ‘স্থানীয় অগ্রাধিকার’ নির্ধারণের মাধ্যমে সর্বাপেক্ষা ক্ষতিগ্রস্থ এলাকাগুলোতে বিপন্ন জনগোষ্ঠী বিশেষত নারী, বয়োজেষ্ঠ্য, ও শিশুর জন্য চাহিদা মাফিক প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। বাজেট প্রণয়নে স্থানীয় প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

৭) জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি অবিলম্বে চালু করতে হবে।