চট্টগ্রাম থেকে কারিতাস বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর বছরব্যাপী উদযাপন শুরু

0
173

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশে হতদরিদ্র, দুর্যোগে বিপর্যস্ত, অসহায়, দরিদ ও নিপীড়িত তথা সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কারিতাস বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরের পূর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী’র বছরব্যাপী উদযাপন শুরু হয়েছে প্রতিষ্ঠানের সূচনাস্থান চট্টগ্রাম জেলায়। কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে বৃহস্পতিবার সকালে বছরব্যাপী যমকালো উদযাপনের শুভ সূচনা করা হয়।

বৃহষ্পতিবার সকালে সেন্ট প্লাসিডস্ স্কুল এন্ড কলেজ প্রাঙ্গণ হতে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন হোটেল সৈকত পর্যন্ত বর্নাঢ্য এক শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রা শেষে হোটেল সৈকতই কারিতাস বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিক উদযাপন শুরু হয়।

পর্যায়ক্রমে জাতীয় পতাকা ও কারিতাস পতাকা উত্তোলন, ফেস্টুন সহকারে বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উন্মুক্তকরণ, বৃক্ষরোপণ, ফটো গ্যালারি/ডিসপ্লে’র উন্মোচন এবং প্রার্থনা ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে জমকালো অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করা হয়। কারিতাস বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী’র আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরে হোটেল সৈকত এক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

কারিতাস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মি. সেবাস্টিয়ান রোজারিও স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বাংলাদেশে কারিতাসের ৫০ বছরের পথ পরিক্রমাকে ভিত্তি করে একটি প্রামান্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো কামরুল হাসান। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর বিশপগণ, কারিতাস বাংলাদেশের পরিচালনা পর্ষদের প্রতিনিধিগণ, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন বিভাগে আঞ্চলিক অফিসের পরিচালকগণ জমকালো উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ফেইসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

এক নজরে কারিতাস বাংলাদেশের ইতিহাস পরিক্রমা
বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কারিতাস বাংলাদেশ। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা অফিস হিসেবে কারিতাসের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পর ক্ষতিগ্রস্থ উপকূলীয় এলাকার জনসাধারণের সাহায্যার্থে চট্টগ্রাম ধর্মপ্রদেশে Chittagong Organization for Relief and Development (CORD) নামে সংস্থাটি গঠিত হয় এবং আরো কিছুদিন পরে সংস্থাটি Christian Organization for Relief and Rehabilitation (CORR) নামে কার্যক্রম শুরু করে। জানুয়ারি ১৩, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয় অর্থাৎ ঢাকায় প্রধান কার্যালয় স্থাপনসহ সারা দেশে কার্যক্রম পরিচালনার রূপরেখা তৈরি হয়।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুন সদ্য স্বাধীন দেশের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন লাভ করে এবং একটি জাতীয় সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীতে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সংস্থাটি কারিতাস বাংলাদেশ নাম ধারণ করে। এর ফলে, ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দকে কারিতাস বাংলাদেশের সূচনা বা জন্ম হিসেবে ধরা হয়। সময়ের বিবেচনায় সংস্থাটি আজ ৫০ বছরের পথ অতিক্রম করতে যাচ্ছে। তাই নভেম্বর, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অক্টোবর, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে কারিতাস বাংলাদেশ-এর সেবাকর্মের যাত্রায় ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সুবর্ণজয়ন্তী/জুবিলী বর্ষ উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বর্তমানে রাজধানী ঢাকার শান্তিবাগে রয়েছে কারিতাস বাংলাদেশ-এর প্রধান কার্যালয়। এছাড়া অঞ্চলভিত্তিক কার্যালয়গুলো হচ্ছে- বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী এবং সিলেট অঞ্চল। এসব অফিসের মাধ্যমে দেশের ৫৩ জেলার ১৮৭টি উপজেলায় কারিতাস কাজ করছে। বর্তমান প্রকল্প সংখ্যা ১১২টি এবং সুফলভোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ।

কারিতাসের রয়েছে তিনটি দেশসেরা স্বনামধন্য ট্রাস্ট মিরপুর এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং স্কুল (মট্স), কোর-দি জুট ওয়ার্কস্ এবং কারিতাস ডেভলপমেন্ট ইন্সটিটিউট (সিডিআই)। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কারিতাস পরিচালনা করছেন ১৮২টি ইউনিট অফিস, ১০টি ট্রেনিং সেন্টার, ২৪৬টি সাইক্লোন সেন্টার, ১১টি টেকনিক্যাল স্কুল, ৩২টি যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নিরাময় কেন্দ্র, ২টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র, ৯টি মাদকাসক্ত, সেক্স ওয়ার্কার, পথশিশু ও নির্যাতন বিরোধী সহায়তা কেন্দ্র এবং ৩৮টি ডে কেয়ার ও হোম কেয়ার কেন্দ্র।

দেশব্যাপী কারিতাস বাংলাদেশের জুবিলী বর্ষে বিশেষ কার্যক্রমসমূহঃ
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও অঞ্চল/ট্রাস্টভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজন: ২৫ নভেম্বর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে কারিতাস চট্টগ্রাম অঞ্চলে কারিতাস বাংলাদেশের ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা। বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানের পর বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট আঞ্চলিক অফিস এবং কোর-দি-জুট ওয়ার্কস্, মট্স ও সিডিআই ট্রাস্ট অফিসসহ প্রকল্প অফিসের নিজস্ব কর্মএলাকায় জুবিলী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে, এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য কর্মএলাকায় জুবিলী উদযাপন করা হবে।

ডকুমেন্টেশন ও প্রকাশনা : কারিতাস বাংলাদেশের ৫০ বছরের কার্যক্রমের উপর বিভিন্ন প্রকাশনা যেমন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র দূরীকরণে কারিতাসের অর্জন, সাফল্যের গল্প, ছবি এবং বিভিন্ন ব্যক্তিদের জীবন অভিজ্ঞতা নিয়ে ডকুমেন্টেশন তৈরি ও প্রদর্শনী করা হবে।

গবেষণা ও কো-কারিকুলাম তৈরি করা: কারিতাস বাংলাদেশ তার ৫০ বছরের পথ চলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দারিদ্র দূরীকরণে কেমন ভূমিকা পালন করেছে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম করা এবং শিক্ষার্থীদের জন্য দয়া ও সেবাকাজের উপর বিশেষ কো-কারিকুলাম প্রকাশ করা হবে।

বিশেষ অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও সম্মাননা প্রদান: বিগত ৫০ বছরে কারিতাস বাংলাদেশের ভালোবাসা ও সেবা কার্যক্রমের পথচলায় বিশেষ সহায়তাকারী/অবদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং সম্মাননা ও কারিতাস পদক প্রদান করা হবে।

মতবিনিময় সভা/ওয়েবিনার: উন্নয়ন সহযোগী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে বিশেষ অনুষ্ঠান/মতবিনিময়, বিভিন্ন বয়স ও পেশার প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে ওয়েবিনার (ভার্চ্যুয়াল সভা) আয়োজন করা, কারিতাস ইন্টারন্যাশনালিজ-এর সদস্যদের সাথে মতবিনিময়, বিভিন্ন পেশার জনগণের সাথে আলোচনা সভা এবং কারিতাসের প্রাক্তণ কর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভা/ওয়েবিনার আয়োজন করা হবে।

টাইম ক্যাপসুল উন্মোচন ও পুনরায় স্থাপন: কারিতাস বাংলাদেশের ২৫ বছরের সিলভার জুবিলী ১৯৯৭ খ্রি: উদ্যাপন করার পর কেন্দ্রীয় অফিসে ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের জন্য স্থাপিত টাইম ক্যাপসুলটি আনুষ্ঠানিক ভাবে খোলা। সেই সাথে আগামী ৭৫ বছরের জুবিলী উদযাপন করার জন্য নতুন করে টাইম ক্যাপসুল স্থাপন করা হবে।

ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক-যুবতীদের নিয়ে অনুষ্ঠান: অঞ্চল/ট্রাস্ট পর্যায়ে ছাত্র-ছাত্রী ও যুবক-যুবতীদের নিয়ে বিশেষ কর্মসূচি, শিশুদের জন্য চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, গল্প বলা প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজন করা। প্রতিবেশিকে ভালবাসা ও দরিদ্র সেবা কাজে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করা হবে।

আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও মানব ভ্রাতৃত্ব সম্প্রসারণ: অঞ্চল/ট্রাস্ট পর্যায়ে বিভিন্ন ধর্মের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে বিশেষ প্রার্থনা ধন্যবাদ ও সংলাপের আয়োজন করার মাধ্যমে মানব সম্প্রীতি তথা মানব ভ্রাতৃত্ব সম্প্রসারণ করা হবে।

পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা: কারিতাস বাংলাদেশের কর্মএলাকার জনগণকে নিয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণে বিশেষ বৃক্ষরোপন অভিযান পরিচালনা করা হবে।

মানব কল্যাণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ: কারিতাস কর্মী এবং স্থানীয় জনগণের সহায়তায় মানব কল্যাণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা নির্দিষ্ট সংখ্যক অতিদরিদ্র, প্রতিবন্ধী, বিধবা, প্রবীণ ও অসহায় ব্যক্তিদের সাহায্য করার মাধ্যমে প্রতিবেশীর প্রতি মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ সৃষ্টি করা হবে।

জুবিলীর ধন্যবাদ ও সমাপনী অনুষ্ঠান: অঞ্চল/ট্রাস্ট পর্যায়ে বছরব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার পরে রাজধানী ঢাকায় সকলের অংশগ্রহণে জুবিলী সমাপ্তি ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে।