আমি টাকা গিলতে চাই

0
285

আমি বাংলাদেশের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের সন্তান। খুব অল্প বয়সেই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে শিখেছি। বয়সের তুলনায় ছোটবেলার স্মৃতিগুলো হৃদয়ে বেশ শক্ত হয়ে আজও গেথে আছে।

১৯৭১-এর যুদ্ধের আগেরও কিছু কিছু ঘটনা মনে আছে, যেমন বাড়িতে কাজের লোকদের রুটি খেতে দিলে তারা অনেক সময় বদনাম করতো। তখন আমার বড় কাকা বলতেন “মোদের রাজা আইয়ুব খান তিনি গমের রুটি খান। তোমাদের খেতে ক্ষতি কী”? তখন সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বাড়িতে মিটিং হতো, কীভাবে পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা যায়। তখন বাপ-চাচাদের বলতে শুনেছি দুইশো বছর ব্রিটিশ আমাদের সব শোষণ করে নিয়ে গেছে। জমিতে নীল চাষ করেছে আর আমরা হয়েছি বঞ্চিত।

ব্রিটিশ তাড়িয়ে ভেবেছিলাম ভালো থাকবো কিন্ত তা আর হলো না। চলছে পাঞ্জাবিদের অত্যাচার, অবিচার। পরে সেই ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হলো। পরিবার এবং দেশের লাখো লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আনা হলো বাংলার স্বাধীনতা। বুক ভরা আশা নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার নতুন চেতনা সবার বুকে। সে যে কী আনন্দ যা আজও চোখে ভাসে। কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল! তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদে থেমে গেলে চলবে না। সংগ্রাম করতেই হবে, মুক্তি একদিন হবেই ইনশাআল্লাহ।

আমরা মূলত এগারো ভাই-বোন। বাবা-মার প্রথম সন্তান জন্মের চার বছর পর কলেরায় মারা যান। তারপর একে একে দশ ভাই-বোনের সংসার বাবা-মার। ১৯৮৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আমার ছোট এক ভাই মারা যায়, বর্তমান আমরা ছয় ভাই তিন বোন বেঁচে আছি। তবে দেশে বসবাস করেন মাত্র একজন। বাবা-মা মারা গেছেন ডিসেম্বর ২০০৬ এবং জানুয়ারি ২০০৭-এ।

যখন দেশে সবাই গ্রামের পরিবেশে বসবাস করেছি তখন দেখেছি বড় একটি মাছ রান্না হয়েছে। মাছের মাথা সবারই পছন্দ কিন্তু মা সমসময় এমনভাবে ভাগ করেছেন যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। অর্থাৎ একবার পেলো একজন, তও পরেরবার পাবে অন্যজন। নির্ভুলভাবেই তিনি এই ন্যায়বিচারটি করতেন। মা-বাবা সবার জন্যই সব সময় ন্যায়বিচার করেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নেন।

সেই থেকেই মূলত শিক্ষা পেয়েছি কীভাবে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে হবে। পরে নিজে বাবা হয়েছি। আমার একটি ছেলে একটি মেয়ে। কখনও তাদেরকে আলাদাভাবে দেখিনি, দুজনকেই সমমানের সুযোগ সুবিধার মধ্যে গড়ে তুলতে শতভাগ চেষ্টা করে চলছি। আবার যখন পরিবারের বাইরে দেশের কথা ভাবি, তখন ভাবি যে দেশের জন্য কিছু করতে হবে। অন্যেরাও যেন আমাদের মতো সুযোগ-সুবিধা পায় এমনটি মন মানসিকাতা আমাদের সবার মাঝে কমবেশি রয়েছে। কারণ আমি সব সময় মনে করি দেশের উন্নতি হওয়া মানেই আমারও উন্নতি যদিও আমি দেশে থাকিনা তারপরও আমার মন-মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এখন আমার ভাবনা যারা দেশে থেকে দেশের মানুষের জন্য সবকিছু করার জন্য জীবন যৌবন দিয়েছে যেমন বঙ্গবন্ধুর কথায় বলি, তিনি জেল হাজত থেকে শুরু করে ভালো মন্দ অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত হয়েছেন ঠিকই তারপরও মানুষের জন্য কিছু করা নিজের দেশের জন্য কিছু করা এ থেকে বিরত হননি কখনও।

তাহলে কেন এমন হলো? বর্তমানে যে ক্ষমতায় আসে সেই লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমরা স্বাধীন, কোনো উপনিবেশিক শক্তি আমাদের শাসন করছে না। আমরা এখন পরস্পর পরস্পরের খুব কাছের মানুষ। তারপরও কেন এতো ভেদাভেদ! রাষ্ট্রের দায়িত্বে যারা আছে তারা তও সেই আমার নিজের বাবা-মার মতো একটি বড় পরিবারের দায়ভার নিয়েছে। তাদেরও তও ঠিক আমার মার মতো সেই একটি মাথা সত্ত্বেও যেন কেউ বাদ না পড়ে এমন করে ম্যানেজ করার কথা? কিন্তু সমস্যাটি তাহলে কোথায়? এতবড় দায়িত্ব পেতে তও দরকার পরম করুণাময় রাব্বুল আলআমিনের আশীর্বাদ! এত বড় সুযোগ পেয়ে কীভাবে সম্ভব দেশের মানুষের পেটে লাথি মেরে তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক টাকার পাহাড় গড়া? ভেবেছে কি তারা এর শাস্তি কত মারাত্মক হবে? মনে হচ্ছে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে।

এত পথভ্রষ্ট যে এরা মনে করছে এমনটি-“আমি সব খেয়েছি কিন্তু কিছুতেই আমার মন, প্রাণ পেট ভরছে না। কী করি? সম্পদের পাহাড় গড়েছি কিন্তু মনে শান্তি নেই। সব রয়েছে, সব হয়েছে কিন্তু রাতে ঘুম আসে না। আমার শরীরে তাবৎ জায়গায় শুধু জ্বালাপোড়া। এটা নেই, সেটা নেই, শুধু নেই আর নেই। অন্যদিকে যা আছে তাও ঠিকমতো উপভোগ করার সময় নেই। কারণ আমি তো ব্যস্ত। ওইযে আমার তও ওটা নেই। ওটার কখনও শেষ হবে না কারণ ওটা চলমান। এমতাবস্থায় আমার মত শত শত লোভী এবং পাপীদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু অর্থ গলাধঃকরণ।

আমাদের এখন এছাড়া ছাড়া কিছু করার নেই। যুগে যুগে এমনটিই হয়েছে যদি আমরা পুরনো ইতিহাস খুলে দেখি। কিন্তু এগুলো দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না কারণ আমি আরো চাই। আমি এখন খেতে নয় গিলতে চাই। আমি এখন মানুষ নই আমি হয়েছি দানব। তাই আমি টাকা গিলতে চাই, দাও আমাকে তোমার যা কিছু আছে আমি শুধু নিবো আর গিলবো। আমার বিশাল উদরপূর্তি করতে প্রয়োজন কাড়িকাড়ি টাকা। টাকা দাও টাকা চাই, টাকা দাও টাকা চাই, টাকা, টাকা, টাকা….”।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। Email: [email protected]