মনে হয় এইতো সেদিন ১৯৭১!

0
219

কামরুন নেছার স্মৃতিচারণা: 

দিনটি ছিল ১৪ই ডিসেম্বর। ঢাকা ছেড়ে আমরা পুরো পরিবার বেড়িয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। গ্রামের যাবার চেনা-জানা পথটাও সেদিন ছিল আমাদের কাছে অজানা আর অচেনা!

তখনকার পরিস্থিতি চেনা-জানা পথটাকেও চির অচেনা করেছিল, সেই পথেই আমরা ছুটছি আজ যে করেই হউক ঢাকা ছাড়তেই হবে। কারণ কিছুদিন ধরে পাক বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় রাতের অন্ধকারে লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর যাকেই নিয়ে যাচ্ছে কেউ আর ফিরে আসছে না! বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরীজীবি। তাই এই হঠাৎ সিদ্ধান্ত।

শুনশান নিরবতার মোড়কে ঘিরে আছে পুরো ঢাকা শহর। ভোর বেলার নিরব, নিস্তব্ধ আর কুয়াশাচ্ছন্ন ঢাকার অলিগলি পথ বেয়ে আমরা সদরঘাটে এসে পৌঁছলাম। এই নিরবতা কোনো নান্দনিক শান্তির পরশ নয়, এ যেন এক ভয়ানক মৃত্যুপূরী।

প্রতিটি মানুষ ভীত আর দিশেহারা, কখন যেন এসে দাঁড়ায় হায়েনার দল! সদরঘাটে এসে আরো দুইটি পরিবারের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। তারাও গ্রামের উদ্দেশ্য যাচ্ছে।

উনাদের সাথে আমাদের পূর্বের কোন পরিচয় নেই। তবুও মূহুর্তের মধ্যে আমরা যেন চিরচেনা আত্মার আত্মীয় বনে গেলাম। কারণ আমাদের কষ্ট ও অনুভূতিগুলো তখন একই রকম ছিল। তিনটি অচেনা পরিবার হয়ে গেলাম অজানা পথের যাত্রী।

নদীর তীরে একটি বজরা নৌকা বাঁধা ছিল, বেশ পুরানো আর রংচটা। বাবাসহ অন্যান্য পুরুষ লোকেরা নৌকার মাঝিকে আমাদেরকে গ্রামে নিয়ে যাবার জন্য অনুরোধ করল। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়ে আর পরিবার নিয়ে আমরা বিপদে আছি। আমাদের দয়া করেন। অনেক অনুরোধের পর মাঝি বললেন, আমি নিতে পারি, আপনারা যদি কষ্ট করে যেতে পারেন।

এটা একটি গুড়ের নৌকা, আমরা যশোর থেকে গুড় এনে ঢাকায় চালান দেই, আবার ঢাকা থেকে আন্যান্য মালামাল চাঁদপুরের বেলতলি বাজারে চালান দেই। নৌকায় কিছুটা জায়গা আছে, ঐ অল্প জায়গায় আমরা সকলে একে একে বসলাম। আমরা সকল মেয়েরা একদিকে বসলাম আর সকল পুরুষ মানুষ এক সঙ্গে । তখন প্রায় দুপুর, তবুও কুয়াশা কাটেনি একটু দূরের কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না।

ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যাচ্ছে না। ভয় আর হতাশা ভরা মন নিয়ে সকলেই নৌকার মাঝে গুটিশুটি মেরে বসে আছি । আমাদেরকে নিয়ে নৌকা চলছে চাঁদপুরের দিকে। বাবা মাঝির সাথে কথা বলছে, মাঝি যেন চাঁদপুর থেকে আরেকটি নৌকা ঠিক করে দেয় আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে যাবার জন্য।

দুপুর হাতেই মাঝি রান্নার জন্য আয়োজন করল। নদীর মাছ আর ডাল-ভাত। এতো গুলো মানুষ। আয়োজন যেমনই ছিলো, অসহায় মূহুর্তে সে খাওয়া যেন ছিল অমৃত। মূহুর্তে খাবার সকলে গোগ্রাসে খেয়ে নিল। এতো মানুষের মাঝে মাঝিদের মাটির সানকি ছিলো মাত্র চারটি, তাই একে একে সকলে সেই সানকিতেই খাবার খেল পরম আগ্রহ নিয়ে।

সেই সময়ে সবার মাঝে কি একতা, কি মমতা। আজ মনে হয় সেদিন মাঁটির পৃথিবীতে স্বর্গ নেম এসেছিল। প্রতিটি মানুষ তখন একজন আরেকজনকে সহায়তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। প্রতিটি মানুষ তখন নিজের সর্বস্ব দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। তখনকার সময়ে সকলের একটাই চাওয়া ছিল আমাদের মুক্তি, আমাদের স্বাধীনতা।

নৌকায় মাঝে মাঝে একটি রেডিও বাজছিল। বিকেলে নৌকায় অনেকে বলাবলি করছিল, আমাদের মুক্তি যোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে গ্রাস করে ফেলছে প্রায়। দেশ স্বাধীন হতে আর বেশি বাকি নাই। এর মাঝে ছোট্ট রেডিওতে বিবিসির সংবাদ শোনা যায়, কলে চুপচাপ অধির আগ্রহ নিয়ে রেডিওতে কান পেতে রইল। সংবাদেও ভালো খবরই বলছে। দেশের অনেক জায়গা এখন মুক্তি যোদ্ধাদের দখলে।

খবর শেষে একজন বলে উঠলো, নদীর পাড়ে টহলদারি পাকিস্তান বাহিনী নাই! তাহলে কি ওরা এখন পালাচ্ছে? হঠাৎ নৌকার নিচে পানি থেকে ডেপ ডেপ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সকলে বেশ উৎসুক ও আতংকিত। মাঝি বললেন, দাঁড়ান আমি দেখছি। মাঝি লাঠি দিয়ে ঐ ঘোলাটে জায়গাটায় গুঁতো দিলে লাঠির সঙ্গে মানুষের মাথার খুলি ও কিছু কঙ্কাল ভেসে উঠে।

নৌকায় অনেকের পরিবারের লোকজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। মানুষের কঙ্কাল দেখে অনেকে কান্নাকাটি শুরু করলেন, একজন মা তার ছেলের জন্য হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। বাবারে, তুই এখনো আহলিনারে! আরেক জন কান্না করছে। কুত্তারা আমার মেয়েটারে নিয়া গেছে, আমার মায় কই।

অসহায় মানুষের আহাজারিতে সকলেই কেঁদে উঠলো। নৌকায় থাকা সকলে একে অন্যকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। তখন বাবা বলে উঠে। দেশকে মুক্ত করার জন্য এমন হাজারও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার খুলি ছড়িয়ে আছে দেশের পথে প্রান্তরে, কেউ জানল না, কেউ চিনলনা ওদের, অথচ স্বাধীনতার জন্য এরা প্রাণ দিয়ে গেল। এরাইতো শ্রেষ্ঠ সন্তান।

সূর্য তার কমলা রঙের শেষ আলোটুকু বিলিয়ে দিল পশ্চিম আকাশের গায়ে। বলাকারা সব ঘরে ফিরছিল। আমি আমার ছোট্ট ভাইটার কান্না থামাচ্ছিলাম। মা অসহায় অপেক্ষায় পানির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর আামাদের নৌকাটা বেলতুলি বাজারে পৌঁছালো। আমরা সকলেই একে একে নৌকা থেকে নামলাম। বাবা নৌকার মাঝিকে বলেন, বাবা আমার এখন যাব কোথায়?

মাঝি বাবাকে অভয় দিয়ে বললেন, ঘাবড়াবেন না। এখানে বেলতুলি বাজারের কাছেই দারোগা বাড়িতে রাতে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতেছি, আর কাল সকালে আমার নৌকায় করেই আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দিব। বাবা শুনে বেশ আশান্বিত হলেন। রাতে দারোগা বাড়িতে আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। উনারা আমাদের যথেষ্ট সেবাযত্ন করলেন। ভালোই কাটলো রাতটা।

পরদিন সকালে নাস্তা করে আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই বজরা নৌকাটি আসলে, আমরা মেঘনা নদী দিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।

এবারের গন্তব্যটা অনেক দূর। মেঘনা নদী হয়ে, তিতাস নদী দিয়ে আমাদের ফুপুর বাড়ি, লড়ি গ্রাম। সারাদিন সারা রাত আমাদের নৌকায় কাটলো। পরদিন কুয়াশা জড়ানো ভোর বেলাতে আমরা গিয়ে লড়ি গ্রামে পৌছলাম। সেদিন ছিল ১৬ ডিসেম্বর।

টানা দুইদিন নৌকায় থাকার পর নৌকা থেকে নেমে আমরা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের মেঠোপথের রাস্তা পেড়িয়ে আমরা ফুপুর বাড়িতে পৌঁছালাম। আমাদের দেখে বাড়ির সকলে দৌঁড়ে এসে জানতে চাইল কিভাবে আসলাম? নানান প্রশ্ন আর কান্নাকাটি।

এমন সময় গ্রামের চারিদিক থেকে কেমন যেন একটা শোরগোল ভেসে আসছিল। মানুষ এদিক সেদিকে ছোটাছুটি করছিল। কেউ কেউ জয় বাংলা, জয় বাংলা বলে জোরে জোরে চিৎকার করছিল। কেউ কেউ হাউ-মাউ করে কাঁদছিল আর পরিবারের লোকজনকে খুজছিল। রেডিওতে বারবার ঘোষণা পাঠ হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। জয় বাংলা…….. বাংলার জয়……..গান বেজে উঠছিল।

তারপর, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ভেসে আসছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধারা খুশিতে আত্মহারা। জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিজয় উল্লাস করছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা পতাকা হাতে। জয় বাংলা জয় বাংলা, বলে দৌঁড়াদৌড়ি ছিল।

হে আল্লাহ আমরা স্বাধীন হয়ে গেছি বলে, বাবা প্রচন্ড খুশিতে চিৎকার করে বেহুশ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি আর মা তার মুখে পানি ছিটিয়ে দিতে থাকলাম। এই দীর্ঘদিনের বুকে জমা পাথর আর আশঙ্কা নেমে যাবার আনন্দে তিনি হয়ত কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে গিয়েছিলেন।

তিরিশ লাখ মানুষের জীবন আর হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর দোয়া রইল যেন আল্লাহ সকলকে বেহেশত বাসী করেন। আমিন। সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি আন্তরিক শুভকামনা। সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

লেখিকা: গৃহিণী

LEAVE A REPLY